মডিউল - ৪
মানসিক চাপ ও রাগ ব্যবস্থাপনা
ব্যক্তির চাহিদা এবং ক্ষমতার মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার ফলে ব্যক্তির নিজের মধ্যে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাকে মানসিক চাপ বলা হয়। অর্থাৎ আমরা যে কাজটি যেভাবে করতে চাই তা যখন পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে করতে পারি না তখন আমরা মানসিক ভাবে চাপ অনুভব করে থাকি। উদাহরণ:
- নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারা,
- পরিবারের সদস্যদের কোন প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারা,
- জোর করে কারো উপর মতামত চাপিয়ে দেওয়া,
- স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করতে না দেওয়া,
- বাজে মন্তব্যের শিকার হওয়া,
- কারো সামনে অপমানিত হওয়া,
- অবহেলিত হওয়া,
- পরীক্ষায় প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।
- মানসিক চাপের ফলে সৃষ্ট পরিবর্তনসমূহ
মানসিক চাপের ফলে শারীরিক, আবেগীয়, আচরণগত বিভিন্ন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। নিম্মে এর কিছু পরিবর্তন উল্লেখ করা হল:
মানসিক চাপের সম্ভাব্য কিছু কারণ নিম্নে দেয়া হল:
১) পারিবারিক সুসম্পর্কের অভাব:
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আবেগীয় বন্ধন সবচেয়ে দৃঢ়। তাদের সাথে আমাদের সবচেয়ে বেশি মতের আদান প্রদান ঘটে। কখনও কখনও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মতের অমিল ঘটে, যার ফলে সদস্যদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এতে মানসিক চাপের সৃষ্টি হয়।
২) কলহ
পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, জাতিগত, প্রথাগত ইত্যাদি ক্ষেত্রে সৃষ্ট কলহ আমাদের মধ্যে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।
৩) শিক্ষা
শিক্ষাক্ষেত্রে অতিরিক্ত প্রতিযোগীতামূলক মনোভাব, যোগ্যতা অনুযায়ী কাঙ্খিত ফলাফল অর্জন করতে না পারা, শিক্ষাবান্ধব পরিবেশের অভাব, আর্থিক অস্বচ্ছলতা, সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব ইত্যাদি বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। অনেক সময় অভিভাবকরা সন্তানদেরকে তাদের সহপাঠীদের সাথে তুলনা করে ফেলেন, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।
৪) কর্মক্ষেত্র
কর্মক্ষেত্রে কাজের চাপ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু অতিরিক্ত কাজের চাপ কর্মীদের মধ্যে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে যা তাদের কাজের গুণগত মান, উৎপাদনশীলতা, কাজের প্রতি আগ্রহ, আত্মবিশ্বাস ইত্যাদি কমিয়ে দেয়। বিভিন্ন কারণে কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে যেমন:
- অতিরিক্ত কাজের চাপ
- নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত কাজ করা
- উৎপীড়ন
- পরিশ্রমের তুলনায় কম পারিশ্রমিক
- সহকর্মীদের সাথে দ্বন্দ্ব
- কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ইত্যাদি
৫) বেকারত্ব
যখন কোন ব্যক্তি তার প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজের সুযোগ না পায় কিংবা কোন ব্যক্তি যখন যোগ্যতার অভাবে কাজে অন্তর্ভুক্ত হতে না পারে তখন মানসিক চাপ অনুভব করে।
৬) পারিপার্শ্বিক
পারিপার্শ্বিক পরিবেশ অনেক ক্ষেত্রে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে থাকে। যেমন: শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, যানজট, তীব্র আলো, কক্ষে অপর্যাপ্ত বায়ু চলাচল, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ইত্যাদি।
- মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু উপায়
মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু উপায় নিম্নে উল্লেখ করা হল
- বাইরে হাঁটতে যাওয়া
- বিশ্বস্ত বন্ধু এবং পরিবারের সদস্যদের সাথে সুন্দর সময় অতিবাহিত করা
- বিশ্বস্ত কারো সাথে মনের কথা শেয়ার করা
- পছন্দের বই পড়া, গান শোনা
- ডায়েরী লেখা
- ব্যায়াম করা
- আয়নায় নিজেকে দেখা
- হাতমুখ ধৌত করা বা গোসল করা
- প্রার্থনা করা
- পর্যাপ্ত পরিমান ঘুমানো
- প্রাকৃতিক পরিবেশে সময় অতিবাহিত করা
- নাক দিয়ে গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে মুখ দিয়ে প্রশ্বাস ছাড়া
রাগ হচ্ছে এক ধরনের মৌলিক অনুভতি যার উৎপত্তি ঘটে কষ্ট, হতাশা,বিরক্তি, আশাহত হওয়া ইত্যাদি থেকে। রাগ প্রকাশের মাত্রা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। সামান্য বিরক্তি প্রকাশমূলক শব্দ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কার্যাবলী সম্পাদনের মাধ্যমে রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। রাগ আমাদের স্বাভাবিক আবেগ। সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করলে এই আবেগ ক্ষতিকর নয়।
রাগের পূর্ব সংকেত হল রাগ পূর্ববর্তী এমন কিছু সতর্কতা মূলক ইঙ্গিত যা আমাদের বুঝতে সাহায্য করে একজন মানুষ কখন রেগে যাচ্ছে। রাগের সংকেতসমূহ হতে পারে শারীরিক, আবেগীয়, চিন্তামূলক কিংবা আচরণমূলক। রাগ পূর্ব সংকেত সম্পর্কে আগে থেকেই সচেতন থাকলে রাগকে ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হয় ফলে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
রাগ পূর্ব সংকেত সমূহ নিম্নে দেয়া হলঃ
১) শারীরিক সংকেত
- হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া
- বুকে চাপবোধ হওয়া
- মাথা ব্যাথা হওয়া
- বেশি বেশি চোখের পলক পড়া
- মাংসপেশীতে টান টান বোধ করা
- ঘাম হওয়া
- শ্বাস কষ্ট হওয়া
- শরীর কাঁপা ইত্যাদি
২) আবেগীয় সংকেত
- বিরক্তিবোধ
- হতাশা
- বিষন্নতা
- হিংসা
- নিরাপত্তাহীনতা
- অগ্রহণযোগ্যতা
- মানসিক অবসাদবোধ
- ভয় পাওয়া
- অসম্মানবোধ
- অপরাধবোধ
- লজ্জাবোধ
- ভবিষ্যতের জন্য দুশ্চিন্তা করা ইত্যাদি
৩) চিন্তামূলক সংকেত
- নিজের সাথে অতিরিক্ত নেতিবাচক কথা বলা
- আক্রমণাত্মক মনোভাব
- প্রতিশোধ পরায়নতা ইত্যাদি
৪) আচরণমূলক সংকেত
- খুব দ্রুত কথা বলা
- উচ্চ স্বরে কথা বলা
- চিৎকার করা
- জোরে দরজায় আঘাত করা
- ভাংচুর করা
- মারামারি করা
- পরিস্থিতিকে এড়িয়ে যাওয়া
- নীরব বা চুপ থাকা
- আমরা কি কারনে এবং কখন খুব সহজেই রেগে যাই
-
- Passive behavior pattern বা নিস্ক্রিয় আচরণের ফলে
- সামাজিক সমর্থনের অভাব
- আবেগীয় বিশৃঙ্খলা বিষন্নতা, উদ্বেগ ইত্যাদি
- মানসিক আঘাতজনিত ঘটনা
- মানসিক চাপ
- আঘাত/ অপমান করে কথা বললে
- হুমকির সম্মুখীন হলে
- নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে বাধাগ্রস্ত হয়ে হতাশ হওয়ার ফলে
- অসম্মানিত হওয়ার ফলে
- অধিকার খর্ব হলে ইত্যাদি
- রাগের ফলে আমাদের কি কি ক্ষতি হয়
-
- শারীরিক ক্ষতি
- মানসিক ক্ষতি
- Career বা পেশাগত ক্ষতি
- পড়ালেখার ক্ষতি
- সম্পর্কের ক্ষতি
- বিষন্নতায় ভোগা
- ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তা করা
- ঘুমের সমস্যা
- নেশায় জড়িয়ে পরা
- একই কাজ বারবার করার প্রবণতা
- Self-harm বা নিজের ক্ষতি করা
- রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি
-
- প্রতিক্রিয়া প্রকাশের আগে কিছুটা সময় নেয়া: কোন ব্যক্তির উপর রেগে গেলে সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করে, কিছুটা সময় নিয়ে নিজের আবেগকে আগে নিয়ন্ত্রণ করে তারপর ঐ ব্যক্তির সাথে কথা বলা। প্রয়োজনে ঐ মহূর্তে ঐ ব্যক্তির সামনে থেকে সরে যাওয়া
- ১১০ পর্যন্ত ধীরে ধীরে গুনতে থাকা: ধীরে ধীরে ১ থেকে ১০ পর্যন্ত গুনতে থাকলে মনযোগ অন্যদিকে সরে যায়, ফলে রাগ কিছুটা কমে যায়। এভাবে কয়েকবার ১১০ পর্যন্ত গুনতে থাকা।
- Assertive ভাবে কথা বলা: কোন প্রকার ক্ষতিকারক আচরণ এবং অন্যকে অসম্মানজনক আচরণ প্রদর্শন না করে নিজের চিন্তা ও অনভূতিকে নম্রভাবে প্রকাশ করা নম্রতার সাথে নিজের মতামত ব্যক্ত করা (কঠোর ভাষায় নয় অথবা অতিরিক্ত নরম ভাষায়ও নয়), সঠিকভাবে চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা (Eye Contact করা), অন্যকে আঘাত বা ব্যঙ্গ করে কথা না বলা, নিজের চিন্তা ও অনভূতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া, সরাসরি কথা বলা, সততার সাথে যুক্তিসঙ্গত কথা বলা
- পর্যাপ্ত ঘুম: পর্যাপ্ত পরিমান ঘুম শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে। ঘুম পরিমিত পরিমানে হলে মন ও শরীর শান্ত থাকে যার ফলে শারীরিক, মানসিক, আবেগীয় (রাগ,দ্বন্দ্ব, ইত্যাদি) সমস্যা মোকাবেলা করা সহজ হয়।
- ডায়েরী লেখা: কারো উপর রেগে গেলে রাগের কারণে , অনুভূতি ইত্যাদি বিষয়গুলো ডায়েরীতে লিখে ফেললে মনের কষ্ট কিছুটা হলেও কমে যায়। ডায়েরীতে মনের কথাগুলো নির্বিঘ্নে প্রকাশও করা যায় এবং কথাগুলোর গোপনীয়তাও বজায় থাকে।
- শরীর চর্চা বা ব্যায়াম করা: নিয়মিত শরীরচর্চা, হাঁটা কিংবা দৌড়ানোর ফলে আমাদের শরীরে কিছু রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয় যা আমাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। রাগের ফলে শরীরে কিছু অতিরিক্ত শক্তি উৎপন্ন হয় যা শরীরের জন্য উপকারী নয়। হাঁটা, দৌড়ানো কিংবা ব্যায়ামের ফলে এইসব অতিরিক্ত শক্তি শরীর থেকে বের হয়ে যায় ফলে উচ্চরক্তচাপ, রাগ ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণে থাকে।
- নিঃশ্বাসের ব্যায়াম করা: নিয়মিত নিঃশ্বাসের ব্যায়াম করলে রক্তসঞ্চালন স্বাভাবিক থাকে। রাগের মহূর্তে আমাদের শরীরের রক্ত সঞ্চালন দ্রুত গতিতে হতে থাকে যা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। রাগের মুহূর্তে নিঃশ্বাসের ব্যায়াম করলে আমাদের শরীর ও মনের স্বাভাবিকতা বজায় রাখা সহজ হয়।
- পরিস্থিতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া: রাগ সৃষ্টিকারী পরিস্থিতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া এবং খোলা জায়গায় কিংবা আশেপাশের কোন পছন্দের জায়গা থেকে কিছুক্ষরে জন্য হেঁটে আসা রাগ নিয়ন্ত্রণের একটি সুন্দর উপায়। আমরা যখনই বঝতে পারব কোন ব্যক্তি বা পরিস্থিতি আমাদেরকে রাগান্বিত করে তুলতে পারে, সেই ব্যক্তি বা পরিস্থিতিকে ঐ মূহুর্তে এড়িয়ে চললে রাগান্বিত হওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখা সম্ভব।
- মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া: কিছু কিছু রাগ সম্পর্কিত সমস্যাগুলি নিজে নিজে ব্যবস্থাপনা সম্ভব হয়না। তাই এমন সমস্যাগুলির ক্ষেত্রে রাগ নিয়ন্ত্ররে জন্য পেশাদার মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে ভাল ফল পাওয়া যাবে।
- মূলবার্তাঃ আমাদের জীবনে যখন কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে তখন আমাদের অনেক ধরনের নেতিবাচক চিন্তা এসে হাজির হয় যা সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মধ্যে নেতিবাচক অনুভূতি যেমন রাগ তৈরি করে। এই রাগ যে কোন ধরনের আচরণের মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ ঘটে। শারীরিক , মানসিক ও আচরণগত কিছু সংকেতের মাধ্যমে রাগের উপস্থিতি বুঝতে পারা যায়। যথাযথভাবে রাগ ব্যবস্থাপনা করতে না পারলে তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায়। রাগকে যথাযথ মাধ্যমে প্রকাশ করা, নিজের অধিকারের কথা খুলে বলা ও অন্যান্য কৌশল গুলো অবলম্বন করার মাধ্যমে রাগ ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব।