Module- 2
কৈশোরকালীন পুষ্টি
পুষ্টি
পুষ্টি হলো একটি প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়াতে খাদ্যবস্তূ খাওয়ার পরে পরিপাক হয় এবং জটিল খাদ্য উপাদানগুলো ভেঙ্গে সরল উপাদানে পরিণত হয়। মানবদেহ এসব সরল উপাদান শোষণ করে নেয়। এসব খাদ্য উপাদান মানবদেহের শক্তি ও যথাযথ বৃদ্ধি নিশ্চিত করে, মেধা ও বুদ্ধি বাড়ায়, রোগ প্রতিরোধ করে, রোগ-ব্যাধি থেকে তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে সাহায্য করে এবং সর্বোপরি কর্মক্ষম করে।
পুষ্টিকর খাদ্য
যেসব খাদ্য খেলে শরীরে তাপ ও শক্তি উৎপাদিত হয়, দেহের গঠন ও বৃদ্ধি হয়, শরীর সবল, কর্মক্ষম থাকে, তাকে পুষ্টিকর খাদ্য বলে। খাদ্য ও পুষ্টি একে অপরের সাথে জড়িত। প্রতিটি খাদ্য অবশ্যই পুষ্টিকর ও নিরাপদ হতে হবে। নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করলে শরীর ও মন ভালো থাকে, মনে প্রফুল্লতা আসে এবং পড়াশোনা ও কাজে মনোযোগ বাড়ে। মনে রাখতে হবে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ না করলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং শরীরে বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়।
কৈশোরে পুষ্টিকর খাবারের গুরুত্ব
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) সংজ্ঞা অনুযায়ী ১০-১৯ বছর বয়স সীমাকে কৈশোরকাল (Adolescence) বলে। এ সময় ছেলে-মেয়ে উভয়েরই স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হয়। দ্রুত ওজন ও উচ্চতার বৃদ্ধি এবং বুদ্ধির বিকাশ ঘটে। তাই কিশোর-কিশোরীদের সঠিক বৃদ্ধির জন্য এসময় পরিমাণমতো পুষ্টিকর ও সুষম খাবার গ্রহণ করা প্রয়োজন। সঠিক পুষ্টি নিয়ে বেড়ে উঠলে কিশোর-কিশোরীদের মেধা ও বুদ্ধির বিকাশ হয়। লেখাপড়ায় মনোযোগ, ভালো ফলাফল এবং কাজ করার সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
খাদ্য
মানবদেহকে সুস্থ-সবল রাখার জন্য খাদ্য অপরিহার্য। খাদ্য বলতে সেই সকল জৈব উপাদানকে বোঝায় যেগুলো মানবদেহ গঠনে ভূমিকা রাখে, ক্ষয়পূরণ করে, শক্তি বৃদ্ধিসহ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। মানুষ খাদ্য থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে।
অতিরিক্ত তথ্য
ওজন ও উচ্চতা বৃদ্ধির একটি আদর্শ মান
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী বয়সের সাথে সাথে দেহের ওজন ও উচ্চতা বৃদ্ধির একটি আদর্শ মান রয়েছে। যদি কোনো শিশু বা কিশোর-কিশোরীদের উচ্চতার (মিটার এককে) তুলনায় ওজন কম অথবা বয়সের তুলনায় কম উচ্চতা থাকে তাহলে তাকে আমরা অপুষ্টি হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি।
বি.এম.আই. (Body Mass Index)
কোনো ব্যক্তির ওজন এবং উচ্চতার হারের বর্গের অনুপাতই হলো বি.এম.আই। এটি পুষ্টিগত অবস্থা নির্ণয়ের একটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি। বি.এম.আই বের করতে ব্যক্তির ওজন কিলোগ্রাম এককে উচ্চতা মিটার এককে জানা প্রয়োজন। ওজনকে উচ্চতার বর্গ দিয়ে ভাগ করলেই বি.এম.আই. পাওয়া যাবে। নিচে সূত্রটি দেয়া হলো-
কিশোর-কিশোরীদের দৈনিক নমুনা খাদ্যতালিকা
*১ বাটি = ২৫০ মি.লি. (১ পোয়া), ১ গ্লাস = ২৫০ মি.লি. (১ পোয়া)
কিশোর-কিশোরীদের পুষ্টিজনিত প্রধান সমস্যাসমূহ
- আয়রন ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতা: কৈশোরকালে প্রধানত আয়রন ঘাটতির কারণে রক্তস্বল্পতা হয় ও মারাত্মক প্রভাব পড়ে দেহের গঠন ও বৃদ্ধির উপর। কিশোর-কিশোরী, বিশেষত কিশোরীদের আয়রন ঘাটতিজনিত সমস্যায় ভোগার কারণ হচ্ছে কৈশোরকালীন খাদ্যাভ্যাস, বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে পরিবারে খাদ্য বণ্টনে অসমতা এবং মাসিকের রক্তক্ষরণ। রক্তস্বল্পতায় শরীর দুর্বল ও অল্পতেই ক্লান্ত হয়, বুক ধড়ফড় করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও কমিয়ে দেয়, যার ফলে বিভিন্ন সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। কিশোরী বয়সে বিয়ে এবং সন্তানধারণ এই রক্তস্বল্পতা আরো বাড়িয়ে দেয়, ফলে কম ওজনের শিশু জন্ম নেয় এবং মা ও শিশু মৃত্যুর হার বেড়ে যায়।
- ফলিক এসিডজনিত ঘাটতি: ফলিক এসিডজনিত ঘাটতির কারণে গর্ভাবস্থায় রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সরকারি স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রগুলো থেকে প্রত্যেক কিশোরীকে আয়রন-ফলিক এসিড বড়ি দেয়া হয়।
- আয়োডিন ঘাটতি: মানবদেহে আয়োডিন একটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান। আয়োডিন ঘাটতি হলে গলগন্ড, খর্বতা ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতাসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়, যা প্রতিরোধে আয়োডিনযুক্ত লবণ খেতে হয়।
- ক্যালসিয়াম ঘাটতি: ক্যালসিয়াম হাড় ও দাঁত গঠনে সাহায্য করে, স্নায়ুকে সবল রাখে এবং শরীরে স্বাভাবিক রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়তা করে। তাই কৈশোরে ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার খেতে হয়।
কিশোর-কিশোরীদের অপুষ্টি নির্ণয় (ওজন, উচ্চতা ও বিএমআই)
ওজন ও উচ্চতা পরিমাপক যন্ত্র, সমতল ও সুবিধাজনক জায়গায় সেট করতে হবে। ওজন পরিমাপের সময় যথাসম্ভব স্বল্প কাপড় পরিধান করতে হবে এবং উচ্চতা পরিমাপের সময় জুতা/স্যান্ডেল খুলে কাঁধ সোজা রেখে সামনের দিকে তাকিয়ে উচ্চতা পরিমাপ করতে হবে।
বিএমআই নির্ণয়ের সূত্র:
অপুষ্টিচক্র:
গর্ভধারণ থেকে শুরু করে ভ্রূণাবস্থা এমনকি নবজাতকের প্রাথমিক অবস্থা পর্যন্ত পুষ্টির গভীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। অপুষ্টি চক্র বংশ পরম্পরায় চলতে থাকে। পুষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগা কিশোরীদের পর্যাপ্ত দৈহিক বৃদ্ধি না হওয়ায় বেঁটে/খাটো হয় এবং তারা কম ওজনের শিশুর জন্ম দিয়ে থাকে। আর এই কম ওজনের শিশুরা যদি মেয়ে হয় তাহলে তারাও বড় হলে খাটো হয় এবং বিয়ে হলে আবারো কম ওজনের শিশুর জন্ম দেয় যা আরো ভয়াবহ। এভাবেই এই চক্র চলতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না এই চক্র ভেঙে যায়। এজন্য জীবনের সকল স্তরেই, বিশেষ করে শৈশব ও কৈশোরে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের মাধ্যমে কিশোরী ও নারীদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে।
পুষ্টি চক্র:
পুষ্টির প্রয়োজন বয়সের সাথে সাথে বদলায়। পুষ্টিজনিত সমস্যার কারণে শৈশবে শিশুর বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হলে তা পুরণ করতে ও সঠিক বৃদ্ধির জন্য কৈশোরে আরো একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়। সুতরাং, কৈশোরে সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করা জরুরি।
কৈশোরকালীন অপুষ্টি প্রতিরোধে করণীয়
- সুষম খাবার, যেমন - শর্করাজাতীয় খাবার (ভাত, রুটি, মুড়ি, চিনি, গুড়, মধু, আলু, চিড়া ইত্যাদি), আমিষজাতীয় খাবার (ডিম, দুধ, মাছ, মাংস, ডাল, বাদাম, বিচি ইত্যাদি), আয়রনসমৃদ্ধ খাবার (মাংস, কলিজা এবং গাঢ় সবুজ শাক-সবজি), ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার (কলিজা, পাকা পেঁপে, আম, গাজর, মিষ্টি কুমড়া, ছোট মাছ, ডিম, সবুজ শাক-সবজি ও হলুদ রঙের ফলমূল) খাওয়া
- প্রতিদিন ভিটামিন সি-যুক্ত খাবার খাওয়া
- আয়োডিনসমৃদ্ধ খাবার (সামুদ্রিক মাছ এবং সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার শাক-সবজি) এবং আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়া
- প্রতিদিন ১০-১২ গ্লাস পানি পান করা
- চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ অনুযায়ী কিশোরীদের আয়রন-ফলিক অ্যাসিড (IFA) ট্যাবলেট খাওয়া (প্রতি সপ্তাহে ১টি করে খাবে)
- প্রত্যেক কিশোর-কিশোরীকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ছয়মাস পর পর কৃমিনাশক বড়ি গ্রহণ করা
- খাবার খাওয়ার আগে ও পরে সাবান এবং নিরাপদ পানি দিয়ে হাত ধোয়া
- স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার করা এবং জুতা বা স্যান্ডেল পরে টয়লেটে যাওয়া
- মাসিকের সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা। মনে রাখতে হবে যে, এ সময় সব ধরনের খাবার খাওয়া যায় এবং সব স্বাভাবিক কাজকর্ম করা যায়
- দেরিতে বিয়ে ও দেরিতে গর্ভধারণ করা (১৮ বছরের পরে)
- কিশোরীকে টিডি (টিটেনাস-ডিপথেরিয়া) টিকার ৫টি ডোজ সম্পূর্ণ করা